নিজস্ব প্রতিবেদক
দিনের বেলা রৌদ্রোজ্জ্বল। সন্ধ্যার আগেই নামছে শীত। সন্ধ্যা পেরিয়ে সকাল পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ কমছে। মাঘের বাতাসে থাকছে হাড়কাপুনি ঠান্ডা। আর এই বাতাসের সঙ্গেই আমের রাজধানী রাজশাহীতে মিলছে আম-মুকুলের মৌ মৌ সৌরভ। ইতোমধ্যেই অনেক আমগাছে মুকুলের দেখা মিলেতে শুরু করেছে।
কিন্তু রোদ ও কুয়াশার খামখেয়ালিপনা মুকুলের জন্য ক্ষতিকর বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ক্ষতির মাত্রাকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে চাষিদের মাঝে ভীতির সঞ্চার ও ভালো ফলনের লোভ দেখিয়ে অতিরিক্ত কিটনাশক ও হরমোন জাতীয় মেডিসিন প্রয়োগে উৎসাহিত করছে কিছু কোম্পানি কর্মিরা।
কৃষি কর্মকর্তার চেয়ে এসব কোম্পানি এজেন্টদের লোভনীয় প্রচারণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন অনেক চাষী। এতে আমবাগানে মুকুলের মন ভুলানো সৌরভের সঙ্গে কিটনাশকের গন্ধও ভেসে আসছে। তবে চিন্তিত না হয়ে, কিটনাশক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে অতি উৎসাহী হয়ে অতিরিক্ত কিটনাশক প্রয়োগ না করে কৃষি কর্মকর্তাদের সঠিক পরামর্শে পরিচর্যা করার আহ্বান জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, রাজশাহীতে এখনও পুরোদমে গাছে মুকুল আসে নি। তবে অনেক গাছেই মুকুল দেখা দিয়েছে। রাজশাহীতে গত বছর ১৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিলো। এবারও কিছু কম বেশি এই পরিমাণই আবাদের সম্ভাবনার কথা বলছে কৃষি অফিস।
নগরী ও পার্শ্ববর্তী উপজেলার বেশকিছু বাগান ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্চের মাঝামাঝিতেই সকল গাছে মুকুল ও গুটি দেখা যাবে। মুকুল আসার আগে গাছে গাছে ছত্রাকনাশক ও ভিটামিন জাতীয় মেডিসিন স্প্রে করা হচ্ছে। এতে আমবাগানে কিটনাশকের ঝাঁঝও থাকছে।
আমবাগানিরা বলছেন, জানুয়ারির শেষের দিক থেকেই আম গাছে মুকুল দেখা দিতে শুরু করে। মার্চের মধ্যে প্রায় গাছে মুকুল চলে আসে। গুটি হয়ে যায়। তবে মুকুল আসার আগে থেকেই গাছের যত্ন নিতে হয়। গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগসহ পোকামাকড় দমনে অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে হয়। মুকুল আসার এই সময়ে এখন গাছে গাছে স্প্রে করতে চাষীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাগানিরা আরও বলছেন, তারা কৃষি কর্মকর্তাসহ কিটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের থেকেও পরামর্শ নেন। যেটা ভালো মনে হয় তখন সেটা করেন।
পবা উপজেলার দামকুড়া ইউনিয়নের আমবাগানি ইব্রাহিম আলী বলেন, তার বাগানের দু’একটা গাছে মুকুল দেখা দিয়েছে। তবে প্রায় সব গাছই ১৫-২০ দিনের মধ্যে মুকুল চলে আসতে পারে। কিছুদিন আগে প্রতিটি গাছের গোড়ায় ইউরিয়াসহ গোবর সার দিয়েছি। ছত্রাকনাশক স্প্রে করেছি। এখন গাছে মুকুল চলে আসলেই আবারও স্প্রে করতে হবে। কারণ কুয়াশা আর দিনের বেলা রোদের কিছুটা প্রখরতার কারণে মুকুলের স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষক বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের অধিকাংশ সময় মাঠে পাওয়া যায় না। অথচ কিটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের ডাকলে বা কাছের দোকানে গেলেই তারা সমাধান দিয়ে দেন। তাদের থেকে কিটনাশকসহ ভালো ফলনের জন্য ভিটামিন জাতীয় কিছু ওষুধ দেন। সেগুলো দিয়ে ভালো ফলনও পাওয়া যায়।
ফল গবেষণা ইনস্টিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোরশেদুল বারি বলেন, কুয়াশা খুব বেশি হলে আম মুকুলের ক্ষতি হয়। পাউডারি মিলডিউ রোগও হতে পারে। এ রোগের কারণে প্রথমে মুকুল সাদাসাদা হয়- পরে কালো বর্ণ ধারণ করে ঝরে পড়ে। দীর্ঘদিন ঘন কুয়াশার কারণে মুকুলে সটিবল বা কালো আস্তরণ পড়ে থাকে। এ থেকে রক্ষা পেতে বাজারে এখন থিয়োভিট পাওয়া যাচ্ছে। এটি ছত্রাকনাশক। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে এটা স্প্রে করলে এই ছত্রাকনাশক থেকে রক্ষা মিলবে।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখনো পুরোদমে গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু করে নি। অগ্রিম কিছু গাছে মুকুল এসেছে। এসময় কিছু পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমাদের সাধারণ চাষিদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কিছু কোম্পানি অতিমুনাফার লোভে অতিরিক্ত রাসায়নিক, হরমোন প্রয়োগ করাচ্ছে।
এতে আমের গুনগত মান ঠিক থাকছে না। অথচ সাধারণ কিছু পরিচর্যার মাধ্যমে আমের গুনগত মান ধরে রেখে উৎপাদন ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা করা যায়। আমের পরিচর্যায় মাত্র ৩ থেকে চারবার স্প্রে করলেই হয়। অথচ কোনো কোনো চাষী ১৫-১৬ বার পর্যন্ত বিভিন্ন কিটনাশক, হরমোন স্প্রে করছে। আবার যেখানে ১ টি মেডিসিনেই কাজ হবে- সেখানে একসঙ্গে একাধিক মেডিসিন দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আমাদের চাষিদের এ বিষয়ে আরও সর্তক হতে হবে। মুনাফালোভী কিছু মানুষের দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক নিয়মে ভালো আম উৎপাদনের আহ্বান জানান তিনি।